আসহাবে কাহফের গুহা কোথায়
“আসহাবে কাহফ”-এর ঘটনা পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে। এ সূত্রেই কোরআনের একটি সুরার নামও ‘সুরাতুল কাহফ’ রয়েছে। আরবি ভাষায় ‘কাহফ’ গুহাকে বলা হয়। প্রতিমাপূজারী এক বাদশাহর শাসনকালে কিছু যুবক মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে একত্ববাদে ঈমান এনে স্বীয় ঈমান রক্ষায় একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পবিত্র কোরআন তার সচরাচর বর্ণনাপদ্ধতি অনুযায়ী ঘটনাটির ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিস্তারিত আলোচনা করেনি। তাই ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে তাফসিরবিদ ও ইতিহাসবিদগণ তার ভৌগোলিক বিষয়ে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশ গবেষকের মত হলো—এটি ঈসা (আ.)-এর ঊর্ধ্বগমনের পরে অর্থাৎ প্রথম থেকে তৃতীয় খ্রিস্ট শতাব্দীকালের মধ্যেই ঘটেছিল। খ্রিস্টীয় উৎসসমূহেও সামান্য পার্থক্যসহ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।
আসহাবে কাহফের গুহার অবস্থান
আসহাবে কাহফের সেই গুহা কোথায় অবস্থিত এ ব্যাপারে গবেষকদের মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, তা তুরস্কের ‘আফসুস’ (যার ইসলামী নাম ‘তরসুস’) নগরীতে। কেউ স্পেনের একটি গুহাকে আখ্যা দিয়েছেন। কারো মতে তা সিরিয়াতে অবস্থিত। কেউ বলেছেন তা জর্দানে অবস্থিত। আবার কারো ধারণা, ইয়ামানে অবস্থিত।
জর্দানে অবস্থিত হওয়ার মতটির প্রাধান্যতা
ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত যে আসহাবে কাহফের গুহা আয়লা (আকাবা উপসাগর)-এর কাছে (অর্থাৎ জর্দানে) অবস্থিত। (তাফসিরে তাবারি : ১৭/৬০২)
ওই বর্ণনাসহ অন্যান্য অনেক লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে যুগের অনেক গবেষক গুহাটি জর্দানে হওয়ার মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মাওলানা হিফজুর রহমান সিউহারভি, ‘কাসাসুল কোরআনে’, সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভি, ‘আরদুল কোরআন’ গ্রন্থে, মুফতি শফি (রহ.) ‘মাআরিফুল কোরআনে’ এতদসংক্রান্ত ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক দলিল-প্রমাণের আলোকে এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (রহ.)-এর মতও এটিই।
তাঁদের গবেষণার সার হলো, জর্দানের ঐতিহাসিক নগরী ‘পেট্রা’র আসল নাম ‘রকিম’ ছিল। রোমান সরকার পরিবর্তন করে ‘পেট্রা’ নামকরণ করে। আর গুহাটি তারই নিকটবর্তী কোথাও অবস্থিত।
জর্দানের সাম্প্রতিককালের উদ্ঘাটন
জর্দানের বিশিষ্ট গবেষক তাইসির জবইয়ান অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন যে এই গুহা সমপ্রতি আম্মানের সন্নিকটে একটি পাহাড়ে উদ্ঘাটিত হয়েছে। তিনি এর গবেষণায় একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। তাঁর উল্লিখিত দলিল-প্রমাণ ও নিদর্শনাবলির ভিত্তিতে আসহাবে কাহফের গুহা এটি হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। তিনি আম্মানের নিকটবর্তী পাহাড়ে একটি গুহার সন্ধান পান, যার মধ্যে কিছু কবর ও মৃতের কঙ্কাল রয়েছে এবং ওপরে একটি মসজিদও নির্মিত আছে। তিনি তাঁর এক সঙ্গীসহ গুহাটির খোঁজে রওনা হন। দীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তাঁরা গুহামুখে পৌঁছতে সক্ষম হন।
তাইসির জবইয়ান তাঁর গবেষণা অব্যাহত রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রফিক রজানি নামক প্রত্নতত্ত্ববিদ অত্যন্ত দক্ষতার সহিত গবেষণা চালিয়ে এটিই আসহাবে কাহফের গুহা বলে মতামত প্রকাশ করেন। এই মতের সপক্ষে নিম্নোক্ত প্রমাণ ও লক্ষণাদি পাওয়া যায় :
১. গুহাটি দক্ষিণমুখী। ফলে কোরআনের এই আয়াতের সঙ্গে মেলে : ‘আর সূর্য যখন উদয় হতো তখন তাঁদের গুহা থেকে ডান দিকে ঝুঁকে অতিক্রম করত। আর যখন অস্ত যেত তখন তার বাম দিকে বেঁকে অতিক্রম করত। আর এরা গুহার প্রশস্ত অংশে ছিল। ’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ১৭)
দাবীকৃত গুহার অবস্থাও এই যে সূর্য উদয় ও অস্তকালে তার ডান এবং বাম দিক হয়ে অতিক্রম করে এবং গুহার অভ্যন্তরে প্রশস্ত একটি খালি জায়গাও রয়েছে।
২. পবিত্র কোরআনে এ কথাও আছে যে জনপদবাসী সেই গুহার ওপর মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা করেছিল। খননকাজের মাধ্যমে আলোচ্য গুহার ওপর একটি মসজিদও প্রকাশিত হয়।
৩. গবেষকগণের বক্তব্য হলো যে মুশরিক বাদশাহর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ‘আসহাবে কাহফ’ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘ট্রাজান’। সে ৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেখানকার শাসক ছিল। মূর্তিপূজার বিরোধীদের ওপর তার অকথ্য নির্যাতনের কথাও প্রসিদ্ধ। ইতিহাসে এ কথাও প্রমাণিত যে ট্রাজান ১০৬ খ্রিস্টাব্দে জর্দানের পূর্বাঞ্চল জয় করে।
নবাবিষ্কৃত গুহাটির ভেতর ট্রাজানের শাসনকালের কিছু মুদ্রা পাওয়া যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে এটিই আসহাবে কাহফের গুহা।
৪. পবিত্র কোরআন আসহাবে কাহফকে ‘গুহা এবং রকিমওয়ালাগণ’ বলেছে। ‘রকিম’ শব্দের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ গবেষকের মতামত হলো, ‘রকিম’ তাঁদের জনপদের নাম ছিল।
নবাবিষ্কৃত গুহাটি থেকে ১০০ মিটার দূরত্বের একটি জনপদের নাম হলো ‘রজিব’। ধারণা করা হয় যে এটি ‘রকিম’ শব্দের বিকৃত রূপ। কেননা এখানকার বেদুঈনরা সাধারণত ‘ক্বফ’কে ‘জিম’ এবং ‘মিম’কে ‘বা’ দ্বারা পরিবর্তন করে কথা বলে। আর চতুর্থ হিজরি শতাব্দীর ভূগোলবিদ আবু আবদুল্লাহ আলবাশ্শারি লিখেন : ‘রকিম পূর্ব জর্দানের আম্মানের নিকটবর্তী একটি শহর। যেখানে একটি গুহাও আবিষ্কৃত হয়েছে। ’ (আহসানুত তাকাসিম, পৃ: ১৭৫)
সপ্তম শতাব্দীর ভূগোলবিদ ইয়াকুত হামাভি-ও ‘রকিমে’র ব্যাখ্যায় লিখেন, ‘আম্মান শহরের অদূরে একটি জায়গা সম্পর্কে সেখানকার অধিবাসীদের ধারণা হলো, সেটিই কাহফ ও রকিম। ’ (মুজামুল বুলদান : ৩/৬১)
মতামতটির সপক্ষে ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহ
কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনামতে পূর্বেকার মুসলমানরা এ অঞ্চলেরই কোনো গুহাকে আসহাবে কাহফের গুহা মনে করতেন। উবাদা ইবনে সামিত (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি রোমসম্রাটের কাছে দূত হিসেবে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে সিরিয়ার পথে ‘রকিম’ নামক পাহাড় অতিক্রম করেন। তাতে একটি গুহাও ছিল। গুহাভ্যন্তরে কয়েকটি কঙ্কালও ছিল।
ঐতিহাসিক ওয়াকেদি (রহ.) লিখেছেন যে সাইদ ইবনে আমের (রা.) সিরিয়া অভিমুখে জিহাদে যাত্রাকালে পথ ভুলে চলতে চলতে রকিম পাহাড়ের কাছে পৌঁছে তা দেখে চিনে ফেলেন এবং সঙ্গীদের বলেন, এটি আসহাবে কাহফের গুহা। তাঁরা সেখানে নামাজ পড়ে আম্মান শহরে প্রবেশ করেন। (ফুতুহুশ শাম : ১/১৭১)
সারকথা, এত প্রাচীন একটি ঘটনার অবস্থানকেন্দ্র সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা তো মুশকিল। তবে সন্দেহ নেই যে এ পর্যন্ত যত জায়গা সম্পর্কে আসহাবে কাহফের জায়গা বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে আলোচ্য গুহাটির সপক্ষেই সর্বাধিক প্রমাণ ও লক্ষণ বিদ্যমান।