ইসলাম

নবীযুগে নারীশিক্ষা যেমন ছিল

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগেও যথারীতি নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তবে তারা পুরুষের মতো মহানবী (সা.)-এর দরসে (পাঠদানের বৈঠক) উপস্থিত হতো না; বরং ভিন্ন পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ করত। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ঘরেই নারী ও শিশুদের কোরআনের পাঠদান করতেন। শিশুরা ঘরেই কোরআন মুখস্থ করত।

একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) ধর্মীয় জ্ঞান বিলুপ্ত হওয়ার কথা বললে সাহাবি জিয়াদ বিন লাবিদ (রা.) বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে কিভাবে জ্ঞান ছিনিয়ে নেওয়া হবে, অথচ আমরা কোরআন তিলাওয়াত করি? আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমরা তা তিলাওয়াত করব এবং আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদেরও তা শেখাব। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৬৫২)

কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.) নারী সাহাবিদের পৃথক মজলিসে যেতেন এবং তাদের দ্বিনি বিধি-বিধান শেখাতেন, উপদেশ দিতেন। ইমাম বুখারি (রহ.) সহিহ বুখারিতে ‘নারীদের পাঠদানের জন্য পৃথক দিন নির্ধারণ করা যাবে?’ শিরোনামে পৃথক পরিচ্ছেদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘নারীরা একদা নবী (সা.)-কে বলল, পুরুষরা আপনার কাছে আমাদের চেয়ে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তাই আপনি নিজে আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারিত করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করলেন; সে দিন তিনি তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের উপদেশ দিলেন। তিনি তাদের যা যা বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে এ কথাও ছিল যে তোমাদের মধ্যে যে স্ত্রীলোক তিনটি সন্তান আগেই পাঠাবে, তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। তখন জনৈক স্ত্রীলোক বলল, আর দুটি পাঠালে? তিনি বললেন, দুটি পাঠালেও। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০১)

আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতি, বিচক্ষণ ও দ্বিনদার নারী সাহাবি। অন্য নারীরা তাঁকে নিজেদের মুখপাত্র ও প্রতিনিধি বানিয়ে নবীজি (সা.)-এর দরবারে প্রেরণ করে। তিনি নবীজি (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, আমি মুসলিম নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার কাছে এসেছি। তারা বলেন এবং আমিও বলি, আল্লাহ আপনাকে নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির জন্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমরা নারীরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আপনার অনুসরণ করেছি। আমরা পর্দা করি, ঘরে থাকি, পুরুষের সব মনো-বাসনা পূর্ণ করি, তাদের সন্তান প্রতিপালন করি। অন্যদিকে পুরুষরা জামাতে নামাজ আদায় করে, জানাজা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এ জন্য তারা মর্যাদা ও পুণ্যের অধিকারী হয়, যখন তারা যুদ্ধে যায়, তখন আমরা তাদের সন্তান প্রতিপালন করি এবং সম্পদ রক্ষা করি, হে আল্লাহর রাসুল, এমন পরিস্থিতিতে আমরা কি পুরুষের সাওয়াব ও প্রতিদানের অংশীদার হবো?

রাসুলুল্লাহ (সা.) আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.)-এর হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা শুনে সাহাবিদের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, আসমা বিনতে ইয়াজিদের আগে তোমরা কি কোনো নারীকে দ্বিনের ব্যাপারে এর থেকে উত্তম প্রশ্ন করতে শুনেছ? তারা বললেন, না। এরপর নবীজি (সা.) বললেন, আসমা, যাও সেসব নারীকে তুমি বলে দাও যে ‘তোমাদের যে নারী নিজের স্বামীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে, তাদের সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করে, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলে, সে পুরুষের সব ভালো কাজের সমান প্রতিদান পাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখে এই সুসংবাদ শুনে আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) আনন্দে তাকবির দিতে দিতে চলে যান এবং নারীদের মহানবী (সা.)-এর সুসংবাদ শুনিয়ে দেন। ’ (মারিফাতুস সাহাবা, হাদিস : ৭৫১২)

এসব ঘটনা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, নারী সাহাবিদের মধ্যে দ্বিন শেখার আগ্রহ কত প্রবল ছিল এবং তারা বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিতেন যে তারা সম্মিলিতভাবে নবীজি (সা.)-এর দাবি পেশ করতেন এবং তিনি তাদের শেখাতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বেশির ভাগ সময় ওয়াজ ও উপদেশের মাধ্যমে নারীদের শেখাতেন। একবার বেলাল (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে নারীদের এক বৈঠকে হাজির হলেন। নবীজি (সা.)-এর আলোচনা শুনে নারীরা দান করতে উদগ্রীব হলো। তারা নিজেদের কানের দুল ও আংটি খুলে দিতে লাগল। বেলাল (রা.) নিজের জামার আস্তিনে তা রাখতে লাগলেন। (তাহজিবুত তাহজিব : ১২/৪২৩)

আয়েশা (রা.)সহ অন্যান্য নারী সাহাবির যেসব বিষয়ে সংশয় তৈরি হতো, সে ব্যাপারে তারা নবীজি (সা.)-এর কাছ থেকে জেনে নিত। আয়েশা ও উম্মে সালমা (রা.)-এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে মাসআলা ও দ্বিনি বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। বয়স্ক ও নিকটাত্মীয় নারীরা সরাসরি নবীজি (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করতেন।

নারী সাহাবিদের মধ্যেও হাদিস বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, ফতোয়া দানকারী, কাতিবাহ (লিখতে পারেন এমন) ছিলেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহাতুল উম্মাহ (জাতির আইনজ্ঞ) ছিলেন, উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামা (রা.) আইনজ্ঞ ও ফতোয়া দানকারী ছিলেন। জয়নব বিনতে আবু সালামা, যিনি উম্মে সালামা (রা.)-এর কন্যা ও নবীজি (সা.)-এর পোষ্য ছিলেন, তাঁর ব্যাপারে লেখা হয় ‘তিনি ছিলেন তাঁর যুগের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকিহা বা আইনজ্ঞ। ’ তাবেঈন আবু রাফে (রহ.) বলেন, আমি যদি মদিনার কোনো নারীদের মধ্যে শুধু জয়নব বিনতে আবু সালামাকেই ফকিহা (আইনজ্ঞ) মনে করতাম।

আবু দরদা (রা.)-এর মাও ছিলেন বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী ও ফিকহ শাস্ত্রে দক্ষ। সামরা বিনতে নুহাইক আসাদিয়া (রা.)-এর ব্যাপারে এসেছে, ‘তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন। তিনি বাজারে ঘুরে ঘুরে ভালো কাজের আদেশ করতেন এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতেন। (অন্যায় দেখলে) নিজের সঙ্গে থাকা ‘কড়া’ দিয়ে মানুষকে আঘাত করতেন। (আল-ইস্তিয়াব : ২/৭৬)

নারী সাহাবিদের মধ্যে আয়েশা ও উম্মে সালামা (রা.) পড়তে জানতেন। হাফসা (রা.) পড়তে জানতেন, লিখতেও জানতেন। শিফা বিনতে আবদুল্লাহ আদাভি, উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা, কারিমা বিনতে মিকদাদ (রা.) প্রমুখ লিখতে জানতেন। নারী সাহাবিদের মধ্যে কয়েকজন কবিও ছিলেন। তাদের মধ্যে খানসা (রা.) ছিলেন সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। তিনি তাঁর ভাই সাখার-এর শোকে যে কবিতা রচনা করেন তাকে আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠতম শোকগাথা মনে করা হয়। এ ছাড়াও হিন্দা বিনতেন উতবা, জয়নব বিনতে আউয়াম, সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব, আতিকা বিনতে জায়েদ (রা.) প্রমুখ নারী সাহাবি কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

Al Amin Hussain

Hello friend, I am (Al Amin Hussain) I am the owner of [Silent Force Team], Unauthorized use of content on this site is illegal, Do not upload site content without my permission. Thanks everyone

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button