ব্যালটের ৭ গুণ ব্যয় ইভিএমে
নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এবং সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করা হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০১৮ সালের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় হবে। এবার ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ করা হলে যা ব্যয় হতো, ইভিএমে হবে তার ৭ গুণ। দেশের অর্থনীতির চলমান সংকটে বিশাল এই ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, ইভিএম ও সিসিটিভি বাদ দিয়ে ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ করা হলে সরকারের বাজেটের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি এই পদক্ষেপ বিরোধী দলগুলোকে আস্থায় এনে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। অন্যদিকে, নির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহারে ইসির প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসিটিভি ব্যবস্থাপনায় ইসির পর্যাপ্ত লোকবল বা সক্ষমতা নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, ‘এমনিতেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনেক দলের আস্থার অভাব রয়েছে। ইসির সঙ্গে সংলাপে অনেক দল অংশও নেয়নি। যারা অংশ নিয়েছে, তাদের বেশিরভাগ ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। নির্বাচন কমিশন তাদের মত না বদলালে দলগুলোর আস্থার অভাব দূর হবে না।’
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশেও তৈরি হয়েছে মন্দার আশঙ্কা। পরিস্থিতি সামাল দিতে এরই মধ্যে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়নের তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয়গুলোতে আপাতত কোনো অর্থ ব্যয় না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা থাকার পরও নির্বাচন আয়োজনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, চলমান অর্থনৈতিক সংকট এবং দেশের রিজার্ভের চাপের মধ্যেই ইভিএম ও সিসি ক্যামেরার পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে, যা সরকারের বাজেটের ওপর চাপ বাড়াবে। ইভিএম নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত থাকায় বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন থেকেই যাবে। এ অবস্থায় ইভিএম প্রকল্প থেকে সরে এলে একদিকে আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভেদ নিরসনের পথ সহজ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইভিএমের জন্য বড় বাজেটের প্রকল্পকে একেবারেই অবাঞ্ছিত আখ্যায়িত করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এটা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ও ন্যায়সংগত উদ্যোগ বলে মনে করি না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি দল ছাড়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজও এটা সমর্থন করছে না। যখন অগ্রাধিকার খাত আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি, তখন এতগুলো টাকা এ সময় খরচ করার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।’ এর পরিবর্তে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।
সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ‘সুন্দর’ জাতীয় নির্বাচন চাইছেন। অন্যদিকে, বেশ কিছু বিষয় সামনে এনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল। ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে সরে এলে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘ইসির সঙ্গে সংলাপে বেশিরভাগ দলই ইভিএমের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ইসি তাদের সেই মতামত পাল্টে দিয়ে ভোটে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। ইসির এমন মানসিকতার পরিবর্তন না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হবে না।’ তিনি বলেন, ‘যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ ত্রুটির কারণে ইভিএম বাদ দিচ্ছে, সেখানে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও ইসি বিশাল ব্যয়ের ইভিএম কার স্বার্থে কিনতে চায়, তা ভেবে দেখা দরকার। সরকারপ্রধান আগামী বছর দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন, খাদ্য সংকটের কথাও বলছেন। সেই সময়ে বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য যন্ত্র ইভিএম কেনা চরম বিলাসিতা। দেশের কথা এবং জনগণের কথা চিন্তা করে ইভিএম কেনা এবং ইভিএমে ভোট করার পদক্ষেপ থেকে সরে আসাই হবে ইসির সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমপক্ষে দেড়শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ এবং সব আসনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। এজন্য ইতোমধ্যেই ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্পের মধ্যেই সিসিটিভি ক্যামেরাসহ নিরাপত্তা সামগ্রীর জন্য ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর বাইরে বাকি আসনগুলোতে ভোট গ্রহণের জন্য ব্যালট পেপার ছাপানো, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সম্মানী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ নির্বাচনের সার্বিক আয়োজনে ব্যয় হবে আরও ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী নির্বাচনে ইসির মোট ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭০০ কোটি টাকা। ফলে বর্তমান পরিকল্পনা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনের আগেরবারের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি ব্যয় হবে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। তবে ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ১৪৭টি আসনে ভোট হয়। এতে মোট ব্যয় হয় ২৬৪ কোটি টাকা।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৭০০ কোটির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা এবং ব্যালট পেপারসহ অন্যান্য খাতে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় একাদশ নির্বাচনে ব্যয় বেড়েছিল ২৯ শতাংশ। আগামী নির্বাচনে সব আসনে ব্যালট পেপারে ভোট হলে সব মিলিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ব্যয় হবে না বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
তাদের মতে, ভোটের যে ব্যয় হয়, তার বড় অংশই যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নির্বাচন পরিচালনায়। ব্যালট ছাপা ও আনুষঙ্গিক খরচ খুব বেশি হয় না। ব্যালটে হোক আর ইভিএমে নির্বাচন হোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নির্বাচন পরিচালনার খরচ একই থাকবে। তবে ভোটে ইভিএম ব্যবহার করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা নির্বাচন পরিচালনা খাতে খরচ না কমে বরং নির্বাচন কর্মকর্তাদের ইভিএমের প্রশিক্ষণ ও ভোটারদের ‘মক ভোটিংয়ে’ বাড়তি ব্যয় হয়।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ কালবেলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা ব্যয় সংকোচনের মধ্যে রয়েছি, সেখানে এত বিরাট ব্যয়ের ইভিএম প্রকল্প নেওয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা, সেটি আরেকবার চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া সময়টি এখন প্রতিকূল। এ বিষয়ে একটু আলাপ-আলোচনা করে যদি প্রচলিত পদ্ধতিতেই নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তাতে তো কোনো ক্ষতি হয় না। তা ছাড়া অনেকেই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাই ইভিএমের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করলে রাষ্ট্রের ৮ হাজার কোটি টাকা বেঁচে যায়। এ টাকা এই দুঃসময়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার প্রকল্পে স্থানান্তর করা যায়। তাহলে সংকট উত্তরণে সরকারের জন্যও সহায়ক হয়।’
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনের ব্যয় ছিল মাত্র ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। তখন ভোটার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ। দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। এ ছাড়া তৃতীয় নির্বাচনে ৫ কোটি ১৬ লাখ, চতুর্থ নির্বাচনে ৫ কোটি ১৫ লাখ, পঞ্চম নির্বাচনে ২৪ কোটি ৩৭ লাখ, ষষ্ঠ নির্বাচনে ৩৭ কোটি ৪ লাখ, অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ৭২ কোটি ৭১ লাখ এবং নবম জাতীয় নির্বাচনে মোট ব্যয় ছিল ১৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।