সব কিছুতে আল্লাহর হিকমত ও রহস্য
আমাদের চারপাশে মাঝেমধ্যে অনেক দুর্ঘটনা দেখতে পাই। যেগুলো দেখে প্রতিটি মানুষেরই মন কাঁদে। আফসোস লাগে, মায়া লাগে, খারাপ লাগে। ছোট্ট একটি অ্যাক্সিডেন্ট আমাদের জন্য অনেকের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে আসে।
মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, ছোট্ট কিশোরকে রেখে মা-বাবা দুজনই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যু পথের যাত্রী হয়েছে। এমন দৃশ্য দেখলেই যে কারো দিল নাড়া দিয়ে ওঠে। নির্মম আর নিদারুণ এ দৃশ্য যেকোনো হৃদয়বান ব্যক্তির অন্তরকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। কিন্তু যিনি রাব্বুল আলামিন, যিনি আমাদের স্রষ্টা তিনি তো আমাদের অনেক বেশি ভালোবাসেন। তিনি কিভাবে এসব বরদাশত করে থাকেন, যা দেখে একজন সাধারণ মানুষ ঠিক থাকতে পারে না। আর তিনি কেন বান্দাকে এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেন।
হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা আমাদের অনেক বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু বান্দার জন্য কোনটা মঙ্গল আর কোনটা অমঙ্গল, এটা আমাদের জানা নেই। এটা একমাত্র ভালোভাবে জানেন আমাদের আল্লাহ তাআলা। এ ধরনের দুর্ঘটনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা আমাদের বড় বড় শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
মহান আল্লাহ তাআলা নিজ জ্ঞান ও হিকমত দ্বারা এই বিশ্ব চরাচরকে কিভাবে পরিচালনা করেন তা আমাদের অজানা। কিছু জিনিস হয়তো আমাদের বুঝে আসে। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে এমন ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে, আপাতদৃষ্টিতে যার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। এবং তার বাহ্যত কোনো কারণও নজরে আসে না। অথচ ঘটনাটির মাঝে কোনো না কোনো হিকমত অবশ্যই নিহিত রয়েছে। মানুষের দৃষ্টি যেহেতু খুবই সীমিত; সে জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের রহস্য বুঝতে সক্ষম হয় না। কিন্তু কখনো কখনো তিনি মানুষকে বোঝানোর জন্য দু-একটি উদাহরণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন। কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা মুসা ও খাজির (আ.)-এর ঘটনা তুলে ধরেন। আল্লাহ তাআলা এই দুই মহামানবের সাক্ষাৎকার কোরআনে কারিমে তুলে ধরে আমাদের বিশেষ বার্তা দিয়েছেন। মুসা (আ.) খাজির (আ.) নৌকাতে আরোহণ করার পর নৌকার মালিকের অনুমতি ছাড়া নৌকার তক্তা উপড়ে ফেলা। কিছু দূর যাওয়ার পর এক নিরাপদ লোককে হত্যা করা। আল্লাহ তাআলা সেই ঘটনা বর্ণনা করেছেন, নৌকাটির ব্যাপার তো এই, সেটি ছিল কয়েকজন গরিব লোকের, যারা সাগরে কাজ করত। আমি সেটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিতে চাইলাম। (কেননা) তাদের সামনে ছিল এক রাজা, যে বলপ্রয়োগে সব (ভালো) নৌকা কেড়ে নিত। আর বালকটির ব্যাপার এই, তার পিতা-মাতা ছিল মুমিন। আমার আশঙ্কা হলো, সে কি না তাদের অবাধ্যতা ও কুফরিতে ফাঁসিয়ে দেয়। (সুরা : কাহাফ, আয়াত : ৭৯,৮০)
অন্যের মালিকানায় কোনো জিনিস তার অনুমতি ছাড়া হস্তক্ষেপ করার ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম। তেমনি কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করাও গুরুতর অন্যায়। এমনকি যদি জানাও থাকে যে সে বড় হয়ে দেশের জন্য মুসিবতের কারণ হতে পারে, তাহলেও তাকে হত্যা করা কোনোক্রমে বৈধ নয়। আর এ কারণেই মুসা (আ.) সঙ্গে সঙ্গে এহেন কাজের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, খাজির (আ.) এসব শরিয়তবিরোধী কাজ কেন করলেন?
মুফতি তাকি ওসমানি সাহেব এ প্রশ্নের চমৎকার বিশ্লেষণ করছেন। ‘বিশ্বজগতে যত ঘটনা ঘটে, আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে তা ভালো মনে হোক বা মন্দ, প্রকৃতপক্ষে তার সম্পর্ক এক অদৃশ্য জগতের সঙ্গে, যা আমাদের চোখের আড়ালে। পরিভাষায় তাকে ‘তাকবিনি জগৎ’ বলে। সে জগৎ সরাসরি আল্লাহ তাআলার হিকমত ও বিধানাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
কোন ব্যক্তি কতকাল জীবিত থাকবে, কখন তার মৃত্যু হবে, কতকাল সুস্থ থাকবে, কখন রোগাক্রান্ত হবে, তার পেশা কী হবে এবং তার মাধ্যমে সে কী পরিমাণ উপার্জন করবে—এ ধরনের যাবতীয় বিষয় সম্পাদনা করার জন্য তিনি বিশেষ কর্মীবাহিনী নিযুক্ত করে রেখেছেন, যারা আমাদের অগোচরে থেকে আল্লাহ তাআলার এ জাতীয় হুকুম বাস্তবায়ন করেন।
উদাহরণত, আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন কোনো ব্যক্তির মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মৃত্যুর ফেরেশতা তার ‘রুহ কবজ’ (প্রাণ সংহার)-এর জন্য পৌঁছে যায়। সে যখন আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনার্থে কারো মৃত্যু ঘটায়, তখন সে কোনো অপরাধ করে না; বরং আল্লাহ তাআলার হুকুম তামিল করে মাত্র। কোনো মানুষের কিন্তু অপর কোনো মানুষের প্রাণনাশ করার অধিকার নেই; কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেই ফেরেশতাকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছেন, তার পক্ষে এটা কোনো অপরাধ নয়। বরং তা সম্পূর্ণ ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ, যেহেতু সে আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করছে।
আল্লাহ তাআলার তাকবিনি হুকুম (সৃষ্টিগত বিধান) কার্যকর করার জন্য সাধারণত ফেরেশতাদের নিযুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি চাইলে যে কারো ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন। খাজির (আ.) যদিও মানুষ ছিলেন; কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে ফেরেশতাদের মতো তাকবিনি জগতের বার্তাবাহক বানিয়েছিলেন। তিনি যা কিছু করেছিলেন আল্লাহ তাআলার তাকবিনি হুকুমের অধীনে করেছিলেন। সুতরাং মৃত্যুর ফেরেশতা সম্পর্কে যেমন প্রশ্ন তোলা যায় না, সে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটাল কেন? কিংবা বলা যায় না যে এ কাজ করে সে একটা অপরাধ করেছে। কারণ সে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এ কাজের জন্য আদিষ্ট ছিল। তেমনি খাজির (আ.)-এর প্রতিও তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো আপত্তি তোলা যাবে না। কেননা তিনিও নৌকাটিতে খুঁত সৃষ্টি করা ও শিশুটিকে হত্যা করার কাজে আল্লাহ তাআলার তাকবিনি হুকুমের দ্বারা আদিষ্ট ছিলেন। ফলে সে কাজ তাঁর জন্য অপরাধ ছিল না।
এ ঘটনার মাধ্যমে মুসা (আ.)-কে খোলা চোখে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্বজগতে যা কিছু ঘটছে তার পেছনে আল্লাহ তাআলার অপার হিকমত সক্রিয় আছে। কোনো ঘটনার রহস্য ও তাৎপর্য যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে তার ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলার ফায়সালা সম্পর্কে কোনো আপত্তি তোলার বিন্দুমাত্র সুযোগ আমাদের নেই। কেননা বিষয়টি যেহেতু তাকবিনি জগতের, তাই এর রহস্য উন্মোচনও সে জগতেই হতে পারে; কিন্তু সে জগৎ তো আমাদের চোখের আড়ালে।
দৈনন্দিন জীবনে এমন বহু ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে, যা আমাদের অন্তর ব্যথিত করে। অনেক সময় নিরীহ-নিরপরাধ লোককে নিগৃহীত হতে দেখে আমাদের অন্তরে নানা সংশয় দেখা দেয়, যা নিরসনের কোনো দাওয়াই আমাদের হাতে নেই। আল্লাহ তাআলা খাজির (আ.)-এর মাধ্যমে তাকবিনি জগতের রঙ্গমঞ্চ থেকে খানিকটা পর্দা সরিয়ে এক ঝলক তার দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন এবং এভাবে মুমিনের অন্তরে যাতে এরূপ সংশয় সৃষ্টি হতে না পারে তার ব্যবস্থাও করে দিলেন। ’
[তাওজিহুল কোরআন থেকে সংক্ষেপিত]