সামাজিক নিরাপত্তায় নেই দরিদ্রদের ৭০ ভাগ
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের গরিব মানুষদের সুরক্ষা দেওয়া; কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশই এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত না। অন্যদিকে, অনেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী : বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে’ শীর্ষক ওয়েবিনারের মূল প্রবন্ধে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকার।
গতকালের এই আলোচনায় সংকটকালীন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ‘সামাজিক বীমা ব্যবস্থা’ চালু করার প্রস্তাব এসেছে। অনুষ্ঠানে বলা হয়, সামাজিক বীমা চালু করলে সংকটের সময়ে সমস্যাগ্রস্ত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ উপকার পাবে। বীমা ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ার কারণে দেশের জনগণের বড় অংশ সামাজিক নিরাপত্তার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
মূল প্রবন্ধে বজলুল হক খন্দকার বলেন, সরকারের দাবি ১৫০টি কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৩৫ ভাগ জনগণকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। তবুও সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা যাদের প্রাপ্য, তাদের ৭০ শতাংশ এই সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ, সহায়তা প্রয়োজন নেই—এমন ৪৩ শতাংশ জনগণ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ঢুকে পড়ছে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষার সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে এই সহায়তাগুলো যাদের প্রাপ্য, তারা অনেকে জানেন না। এ জন্য তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেশিরভাগ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি। খাদ্যের পরিবর্তে টাকা দেওয়া হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি সুবিধা পাবে। কারণ, মোবাইল ব্যাংকিং বা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে ভাতার পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় একজন বয়স্ক ব্যক্তির জন্য প্রতি মাসে গড়ে ৬০০ টাকা বরাদ্দ থাকে, যা তার চিকিৎসা, খাবার ও অন্যান্য খরচ বিবেচনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জিডিপির আড়াই থেকে ৩ শতাংশ ব্যয় করা হয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে। সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বাদ দিলে শুধু দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যয় হচ্ছে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
বজলুল হক খন্দকার বলেন, সরকারি হিসাবে দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনো সামাজিক কর্মসূচির আওতায় নেই। এসব জনগণের জন্য সামাজিক বীমা বা চাকরির ব্যবস্থা করা উচিত। যেখানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি চাকরি দিয়ে অথবা চাকরি হারানো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করা যেতে পারে। অথবা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের যোগসাজশে সামাজিক বীমা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যেখান থেকে দরিদ্ররা শুধু সরকারের বিনিয়োগ থেকে সহায়তা নেবে, বাকিরা নিজেদের বিনিয়োগের সুবিধা নিতে পারবে।
তিনি বলেন, যে কোনো সংকটের সময় দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি থাকলেও এ দুই জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না। তারা কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারে না বা লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হলে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সামাজিক বীমা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
তিনি দুর্যোগের সময় দেশের জনগণের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, সরকারের ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে দুর্যোগকালীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করা উচিত। তাতে এ কর্মসূচির সফলতা বেশি পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এটা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যৎ সামাজিক নিরাপত্তার জন্য রাজনীতিবিদদের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।